
চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মেখল ও গড়দুয়ারা ইউনিয়ন এবং রাউজান থানার গহিরা ইউনিয়নের সংলগ্ন হালদা নদীতে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি সুইচগেইট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি জবরদখলের অভিযোগে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে সংস্থাটি।
জমি দখল ও ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগস্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, সুইচগেইট নির্মাণকাজে তার ৭০.৭৫ শতক খরিদা সূত্রে ক্রয়কৃত জমি দখল করে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। জমিটিতে তার একটি ডেইরি ফার্ম, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছের প্রকল্প ও বিভিন্ন ফলদ গাছ ছিল, যেখানে তিনি প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, ঠিকাদাররা কোনো নোটিশ বা আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়াই হঠাৎ তার স্থাপনা ভেঙে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে তাকে মাত্র ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। অথচ ওই এলাকায় প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য এক লাখ টাকার বেশি।
আইনে কী আছে? ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭ (অ্যাক্ট নং ২১) অনুযায়ী—অধিগ্রহণের নোটিশ: সরকারি বা জনস্বার্থে জমি প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসক জমির মালিককে লিখিত নোটিশ প্রদান করবেন।
ন্যায্য বাজারমূল্য: জমির গত ১২ মাসের নিবন্ধিত দলিল অনুযায়ী বাজারমূল্য নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ: বাজারমূল্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ২০০% পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে।
স্থাপনা ও ফসলের ক্ষতিপূরণ: জমিতে থাকা বাড়িঘর, গাছপালা, মাছের ঘের বা কৃষিজ প্রকল্পের ক্ষতিও হিসাব করে দিতে হয়।
নোটিশ ছাড়া ভাঙচুর অবৈধ: ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে না দিয়ে দখল বা ভাঙচুর করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।আইন উপেক্ষা করে যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আদালতের মাধ্যমে স্থগিত বা নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা: অভিযোগের পর রফিকুল ইসলাম আদালতে মামলা করলে আদালত প্রকল্পের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর প্রমাণস্বরূপ প্রকল্প এলাকায় একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টানানো হয়েছে, যেখানে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ বন্ধ রাখার কথা উল্লেখ রয়েছে।
জনদুর্ভোগ বাড়ছে: এদিকে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে আশপাশের জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। বিকালের পর থেকে অনেক গ্রাম গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড চাইলে জমির মালিককে ন্যায্য প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে পারতো। কিন্তু তারা সঠিক প্রক্রিয়া এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করেছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: চট্টগ্রামের এক সিনিয়র আইনজীবী বলেন—“ভূমি অধিগ্রহণ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, মালিককে নোটিশ ছাড়া সরকারি প্রকল্পে জমি নেওয়া যাবে না। ক্ষতিপূরণ ন্যায্য বাজারমূল্য অনুযায়ী দিতে হবে। যদি এ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা হয়, তবে তা অবৈধ এবং আদালত স্থগিতাদেশ দেবে। এখানে সেটাই ঘটেছে।”
স্থানীয়দের দাবি: এলাকাবাসীর মতে, হালদা নদীর এই সুইচগেইট প্রকল্পটি জনস্বার্থে জরুরি। তবে জমির মালিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করলে শুধু প্রকল্পই স্থগিত থাকবে না, বরং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগও দীর্ঘায়িত হবে।অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি “জনদুর্ভোগ” এর কথা বলে এলাকাবাসীকে উস্কে দিচ্ছেন। তারা জনস্বার্থকে অজুহাত বানিয়ে রফিকুল ইসলামের ন্যায্য অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করছেন।
ভুক্তভোগীর দাবি—“আমি জমি কিনে বৈধ মালিক হয়েছি। এখানে আমার কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল। আমাকে আমার এই জায়গার পাশে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। আমাকে আমার ক্রয়কৃত জায়গায় যেতে না দিয়ে আমার কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করেছে। কিন্তু কিছু লোক জনদুর্ভোগের কথা বলে আমাকে উস্কানি দিয়ে হক থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে।
প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই ফায়দা নিতে চায়।”উপসংহারসচেতন মহলের মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ড চাইলে জমির মালিককে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান ও আইনগত প্রক্রিয়া মেনে কাজ এগিয়ে নিতে পারতো। এখন আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতে প্রকল্প এবং জনদুর্ভোগ—উভয়ই অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
তাই উন্নয়ন প্রকল্প যেমন জনস্বার্থে জরুরি, তেমনি জমির মালিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় এ ধরনের প্রকল্প কখনোই সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।