
দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন চান্দু মিয়া। জটিলতা বাড়ায় রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তবে এই হাসপাতালে আইসিইউ সেবা চালু না থাকায় সাধারণ ওয়ার্ডে ঝুঁকি নিয়ে চলছিল তাঁর চিকিৎসা। এটি গত রোববারের ঘটনা। গতকাল মঙ্গলবারও আইসিইউ সেবা চালু হয়নি। এমন পরিস্থিতি শুধু সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়; লোকবল না থাকায় সোহরাওয়ার্দীসহ দেশের বড় ১৪টি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা বন্ধ রয়েছে। এতে গত চার মাসে প্রায় ১৪ হাজার রোগী প্রাণরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে প্রতিদিন অন্তত ৫০ জনের এমন জরুরি সেবা প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেবা মেলে না। এর মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে আইসিইউ সেবা নেন। দরিদ্র রোগীরা টাকার অভাবে এ সেবা নিতে পারেন না।সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, জনবল সংকটের কারণে চার মাস ধরে এই জরুরি সেবা বন্ধ আছে। জনবল চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো উত্তর আসেনি।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শ্বাসকষ্টের রোগী বেড়ে যাওয়ায় কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের অধীনে ৪৮ জেলায় সরকারি হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৩ জেলায় আইসিইউ সেবা চালু হয়েছিল। জনবল সংকটে কিছু জেলায় আইসিইউ সেবা বন্ধ হয়ে যায়।প্রকল্পের নথিতে দেখা যায়, ২০২০ সালে ৪৮ জেলায় হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করতে ৫১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে একটি আইসিইউ প্রতিস্থাপনে খরচ হয়েছে গড়ে ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে ১৪টি হাসপাতালের আইসিইউতে এখন ১৪৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ১৪ হাসপাতালে আইসিইউ সেবা সচল রাখা গেলে বহু মানুষের জীবন রক্ষা হতো। দুঃখের বিষয়, সচল করা যাচ্ছে না। এতে একদিকে রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবায় প্রভাব পড়ছে। যত দ্রুত সম্ভব আইসিইউ সেবা সচল করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার।যেসব হাসপাতালে আইসিইউ সেবা বন্ধ আছে সেগুলো হলো– ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া), শেরপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল, বাগেরহাট জেলা সদর হাসপাতাল, মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতাল এবং মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কভিড-১৯ ইআরপিপি প্রকল্পের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে মেডিকেল অফিসার, নার্স, টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্যকর্মীসহ ১ হাজার ৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব জনবল দিয়ে এতদিন আইসিইউ সেবা সচল ছিল। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে চাকরি হারান চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। নতুন জনবল চেয়ে হাসপাতালগুলো চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. শেখ ছাইদুল হক সমকালকে বলেন, আইসিইউ পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন। জনবল না থাকায় কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায় কিছু চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান দিয়ে এসব আইসিইউ এতদিন সচল রাখা হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর এখন চাকরি নেই।
প্রকল্পের জনবল রাজস্বে স্থানান্তরের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সেটি বাতিল করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, এসব আইসিইউ সচল করতে নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে সেটি সময়সাপেক্ষ। নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত আইসিইউগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
ঢাকার বাইরের চিত্র
দায়িত্বে থাকা ডাক্তার-নার্সের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের জেনারেল হাসপাতালে গত ডিসেম্বরে ১০ শয্যার আইসিইউ সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রতিদিন এই হাসপাতাল থেকে আইসিইউ সুবিধা দরকার– এমন ১০ থেকে ১৫ রোগীকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে এমন মুমূর্ষু রোগী রাজধানীতে এসে আরও ভোগান্তিতে পড়ছেন।
বাগেরহাট জেলা সদর হাসপাতালে জানুয়ারি থেকে আইসিইউ সেবা বন্ধ হয়ে যায়। মাসে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ রোগীকে আইসিইউ না থাকায় খুলনা বা ঢাকায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়। অনেক সময় পথেও রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, ‘দ্রুত এ সেবা চালুর উদ্যোগ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
চার মাস ধরে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের ১০ শয্যার আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সাদেকুর রহমান জানান, আইসিইউ চালাতে হলে সার্বক্ষণিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। হাসপাতালে চার মেডিসিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হলেও এখন একজনও নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার একটি আইসিইউ ইউনিটের যাত্রা শুরু হয়। এ ইউনিট দেড় বছর ধরে তালাবদ্ধ। হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, জনবলের অভাবে আইসিইউ চালু করা যায়নি।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে দুই বছর আগে ১০ শয্যার আইসিইউ স্থাপন হলেও জনবলের কারণে এখনও চালু করা যায়নি। হাসপাতালের আটতলার আইসিইউ কক্ষের দরজা স্থাপনের দিন থেকেই তালাবদ্ধ। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ১০ বেডের আইসিইউ চালু রাখতে সাতজন মেডিকেল অফিসার ও তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন। এই জনবল পাওয়া যায়নি।
শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট কিছুদিন চলার পর জনবলের কারণে বন্ধ হয়। হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. জসীম উদ্দিন বলেন, আইসিইউ সেবা বন্ধ থাকায় রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে আইসিইউ ইউনিটের কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি। এতে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার মানুষ। ইউনিটটি ভেন্টিলেটর, বেডসহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো হয়। এখন সেভাবে পড়ে আছে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘লোক নেই, তাই আইসিইউ ও সিসিইউ চালু করতে পারছি না।’মাদারীপুর সদর হাসপাতালে স্থাপনের পর থেকেই পড়ে আছে আইসিইউ। মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা. শরিফুল আবেদীন কমল বলেন, পরিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও লোকবল ছাড়া আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এসব যন্ত্র দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
করোনাকালে যশোর জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ সেবা চালু হলেও এখন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ১০ শয্যার আইসিইউতে মাঝেমধ্যে চিকিৎসক না থাকায় রোগী ভর্তি রাখা হয় না। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আহসান কবীর বাপ্পী বলেন, আইসিইউতে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকাটাই যথেষ্ট নয়, একটি প্রশিক্ষিত টিমের প্রয়োজন, যেটি এ হাসপাতালে ঘাটতি রয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, আইসিইউর যন্ত্র স্পর্শকাতর। দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে অধিকাংশ অকেজো হয়ে যাবে। এগুলো সচল রাখতে কী করা যায়, তার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা উচিত। কমিটি সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করবে।