
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান অন্তত ২৬ বছর যুক্তরাষ্ট্রে নিজের পরিচয় গোপন করে ছিলেন, কিন্তু কেনো? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং এই বিষয়টি পরিণত হয়েছে টক অব দ্যা টাউনে। যুক্তরাষ্ট্রে খলিলুর রহমান ওরফে ‘রজার রহমান’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন বলে নিশ্চিত করে প্রতিবেদকন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিকগণমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজ।
এদিকে শনিবার (১৭ মে) সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, খলিলুর রহমানের শুধু বাংলাদেশি নাগরিকত্বই নয় তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও রয়েছে এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব পরিচয়ের কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নির্বাহী কোন দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মত স্পর্শকাতর পদে থাকার অধিকারতো আরও নয়।সালাউদ্দিন আহমেদের এমন মন্তব্যের পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আলোচনার ঝড়। আত্মরক্ষায় খলিলুর রহমান ওরফে রজার রহমান রোববার (১৮ মে) চ্যালেঞ্জ করেন সালাউদ্দিন আহমেদকে। আদালতের সামনে তার দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়টি প্রমাণ করতেও বলেন তিনি। এমনকি একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে খলিলুর রহমান তার অধিকার পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করতে প্রস্তুত বলেও জানান।
সালাউদ্দিন আহমেদ এবং খলিলুর রহমানের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পরে অনুসন্ধানে খলিলুর রহমানের বিষয়ে বের হয়ে আসে বেশ চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। মার্কিন নাগরিকত্ব সম্বলিত খলিলুর রহমানকে খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে আত্মগোপনে থাকা রজার রহমানের পরিচয়। মার্কিন নথি ঘেটে দেখা যায় অন্তত ১৯৯৮ সালের পর থেকে কমপক্ষে জুন ২০২৪ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন খলিলুর রহমান ওরফে রজার রহমান। এই সময়ের মাঝেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রজার রহমান নামে নিবন্ধিত এবং নাগরিকত্ব লাভ করছেন। এমনকি রজার রহমান পরিচয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতেও নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই রজার রহমানের বেশ কয়েকটি ঠিকানার সন্ধানও পাওয়া গেছে যেখানে তিনি বছরের পর বছর ধরে স্ব-পরিবারে বসবাস করে আসছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে, খলিলুর রহমান ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টির ২৯, ব্রেটন রোড, স্কারসডেল এনওয়াই ১০৫৮৩-এ থাকতেন (বা এখনও থাকেন)। নিউইয়র্কের স্কারসডেলের এই ঠিকানা ছাড়াও, খলিলুর রহমান ওরফে রজার রহমানের সাথে ম্যাসাচুসেটস এবং কানেকটিকাটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে দশটি ঠিকানা জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ মিলেছে। খলিলুর রহমানের ঠিকানাগুলি হল: ১, কোয়েকার লন, গ্রিনউইচ সিটি ০৬৮৩১, ফেয়ারফিল্ড কাউন্টি, ১৮২, ওয়েভার স্ট্রিট, গ্রিনউইচ সিটি ০৬৮৩১, ১৭, ক্লাইড রোড, ওয়াটারটাউন এমএ ০২৪৭২, মিডলসেক্স কাউন্টি (ম্যাসাচুসেটস), ১. লেইটন স্ট্রিট, ইউনিটি ১৩০৭, ক্যামব্রিজ এমএ ০২১৪১, মিডলসেক্স কাউন্টি, এবং ১১, সিনিক লন, ইয়ঙ্কার্স এনওয়াই ১০৭১০, ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টি।মার্কিন রেকর্ড অনুসারে খলিলুর রহমানের স্ত্রীর নাম নুরুন নাহার রহমান। তার এক বোন সেলিন ডিমাত্তেও (একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের সাথে বিবাহিত), যিনি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাসেটে বসবাসকারী একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ।
বর্তমানে, তিনি সেলিন রহমান-ডিমাত্তেও নামেও পরিচিত। সম্ভবত খলিলুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার পর সেলিন রহমান সেখানে চলে আসেন। রেকর্ডগুলিতে খলিলুর রহমানের আরও ১৩ জন আত্মীয়ের তালিকা রয়েছে যারা নিউ ইয়র্কের স্কারসডেল এবং এর আশেপাশে থাকেন। এদের মধ্যে তার মেয়েরাও রয়েছেন, যাদের একজন হলেন লামিয়া নওরীন।খলিলুর রহমান ওরফে রজার রহমানে বিষয়ে নিউইয়র্কের ব্যাকগ্রাউন্ড রিপোর্ট বলছে, খলিলুর রহমানের বয়স ৭১ বছর। ১৯৯৮ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ২৬ বছর তিনি ২৯, ব্রেটন রোড, স্কারসডেল এনওয়াই ১০৫৮৩ ঠিকানায় বসবাস করছেন। তার আগে খলিলুর রহমান ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ১, কোয়েকার ল্যান্ড, গ্রিনউইচ, সিটি ০৬৮৩১-এ ৪ বছর বসবাস করেছিলেন। তাছাড়া, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ৪ বছর ৩৬ আলেকজান্দ্রিয়া ডক্টর, অক্সন হিল এমডি ২০৭৪৫ ঠিকানায় থাকারও খোঁজ মিলেছে খলিলুর রহমানের বিষয়ে।২৬ বছর ধরে স্ব-পরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এই রজার রহমানই যে খলিলুর রহমান প্রমাণ করে খলিলুর রহমানের ব্যবহার করা ‘রজার রহমান’ নামের ফেইসবুক হ্যান্ডেল।
অসংখ্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এক, খলিলুর রহমান হলেন ‘রজার রহমান’-এর একই ব্যক্তি এবং দুই, তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। যদিও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার পাঁচ মাস আগে এবং দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার দশ মাস আগে ‘রজার রহমান’ নামের ফেইসবুক প্রোফাইলটি পরিচালনা করা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।বিভিন্ন প্রোফাইল এবং কভার ফটোর নিচে করা মন্তব্যগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, ‘রজার রহমান’ এবং তার স্ত্রী (নুমান, যিনি সাথী ডাকনামে পরিচিত) হলেন খলিলুর রহমান দম্পতি। কেন না তাদের চেহারা এবং ছবি হুবহু মিলে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন ছবি কিংবা পোষ্টের মন্তব্যে ঘরে রজার রহমানকে খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রীকে সাথী নামেও সম্বোধন করতে দেখা যায় এবং বিভিন্ন জনের মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে তিনি ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছিলেন।