
রংপুরের গঙ্গাচড়ার একটি নিরীহ গ্রাম যেন হঠাৎ করে সহিংসতার বিভীষিকায় পরিণত হলো। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তির অভিযোগে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের ঘটনার পর, উত্তেজিত উগ্রবাদী জনতা দুই দফায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৮টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। আবারও হামলার ভয়ে সহায় সম্বল নিয়ে গ্রাম ছেড়েছে প্রায় ২৫টি হিন্দু পরিবার।
প্রথম হামলা চালানো হয় শনিবার রাত ১০টার দিকে, এরপর আবার রবিবার দুপুরে স্থানীয় মসজিদের মাইক ব্যবহার করে জনতা জড়ো করে ‘মানববন্ধন’-এর নামে মিছিল নিয়ে এসে নতুন করে হামলা চালানো হয়। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত একজন হামলাকারীকেও গ্রেফতার করা হয়নি, যদিও কটূক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত কিশোরকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লুটপাটের সময় গরু, ফ্রিজ, টিভি, স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত লুটে নেওয়া হয়। হামলার সময় পুলিশ ক্যাম্পের মাত্র ৫০০ গজ দূরে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ।
হামলার পর থেকেই আক্রান্ত পরিবারগুলো ভয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে। আজ দুপুর পর্যন্ত গঙ্গাচড়ার ২৫টিরও বেশি হিন্দু পরিবার গ্রাম ত্যাগ করেছে। যারা এখনও রয়েছেন, তারাও চরম আতঙ্কের মধ্যে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। অনেককে মোবাইল ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, “আমার বাড়ির মালামাল সব নিয়ে গেছে। থানায় গেলে বলে লিখিত অভিযোগ নাই। পুলিশ নিজেরা বাদী হয়ে মামলা করতে পারে না?”প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখেসংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও কেন হামলা প্রতিরোধ করা যায়নি এবং কেন এখনও কোনো হামলাকারী গ্রেফতার হয়নি, তা নিয়ে প্রশাসনের নিরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।গঙ্গাচড়া থানার ওসি বলেন, “আমরা তদন্ত করছি, কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি এখনো। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করতে পারে, এবং এমন ভয়াবহ হামলার পরও কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ বা গ্রেফতার না হওয়া উদ্বেগজনক।রাজনৈতিক ও সামাজিক নীরবতাএই ঘটনার পর কোনো মূলধারার রাজনৈতিক নেতা এখনো ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেননি, কিংবা কোনো বিবৃতি দেননি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, বিচার এবং পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারি কোনো পরিকল্পনার কথাও এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।
সামাজিক মাধ্যমে ইতোমধ্যে নিন্দার ঝড় উঠেছে, এবং নাগরিক সমাজ এ ঘটনায় দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।গঙ্গাচড়ার ঘটনাটি যেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি পুনরায় নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবচিত্র তুলে ধরল। একদিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দোষীকে আইনের আওতায় আনা হয়, অথচ প্রতিশোধের নামে নিরীহ মানুষের ওপর চালানো হামলার ঘটনায় কোনো দায় কিংবা জবাবদিহিতা নেই।