Home / অন্যান্য / ‘মিডিয়া ট্রায়ালে’র মাধ্যমে বিরাজনৈতিকীকরণের পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি

‘মিডিয়া ট্রায়ালে’র মাধ্যমে বিরাজনৈতিকীকরণের পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি

দেশ ধ্বংসের নতুন অস্ত্রের নাম ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। ‘মিডিয়া ট্রায়ালে’র মাধ্যমে বিরাজনৈতিকীকরণের পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গুজব ছড়িয়ে জনগণকে আতঙ্কিত করে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, কয়েকটি মূল ধারার গণমাধ্যমও এখন গুজবের ফ্যাক্টরি।

বিচারের আগেই কিছু মিডিয়া রায় ঘোষণা করে দিচ্ছে। দোষী করা হচ্ছে নিরীহ মানুষকে। যাকে খুশি তাকে হত্যা মামলার আসামি বানানো হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় করার মাধ্যমে পুরো সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অস্থিরতা।

ঠিক এ রকমই একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়। সেই একই ধরনের প্রবণতা এখনো দৃশ্যমান। শুধু পার্থক্য, সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না। আর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে মিডিয়া ট্রায়ালের হাতিয়ার বানানো হয়েছে।দেশের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতির জন্য কারা সবচেয়ে বেশি দায়ী? এ নিয়ে যদি অনুসন্ধান চালানো হয়, তবে দেখা যাবে—কিছু গণমাধ্যমের দায়িত্বহীন আচরণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম দায়িত্বশীল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু কিছু গণমাধ্যম দেশকে বিদেশিদের ‘লীলাভূমি’তে পরিণত করতে চায়। বিরাজনৈতিকীকরণ বাস্তবায়ন করতে চায়। সুধীসমাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চায়।

জুলাই বিপ্লবের পর সবাই প্রত্যাশা করেছিলেন একটি সুখী সমৃদ্ধ বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। যেখানে সব মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবেন। ভয়, আতঙ্ক থেকে মুক্ত হবেন। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর দেশে বিরাজনৈতিকীকরণের এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে একটি মহল। আর তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে কিছু গণমাধ্যম। যারা দেশে হানাহানি, বিভক্তি উসকে দিচ্ছে। যাদের কারণে দেশে আবার নতুন করে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে।গত প্রায় ১০ মাসে দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১৫ হাজার মামলা হয়েছে। এসব ভুয়া মামলায় আসামি করা হয়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষকে। কারাগারগুলোয় এখন তিলধারণের ঠাঁই নেই। এসব মামলা তদন্তে কোনো অগ্রগতিও নেই। সবাই জানে, বেশির ভাগ মামলাই ভুয়া। মামলাগুলো যে ভুয়া তা স্বীকার করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকেও। আর এই মামলাগুলোর বিষয়ে উসকানি দিচ্ছে এক শ্রেণির গণমাধ্যম। যারা বিচারের আগেই একজনকে দোষী সাব্যস্ত করছে। ফলাও করে এসব ভুয়া মামলার খবর প্রকাশ করছে। আসামিদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের সম্মানহানি ঘটিয়ে পুরো সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে।

গত বছর ৫ আগস্টের পর কিছু সুযোগসন্ধানী উচ্ছৃঙ্খল জনতা মব সন্ত্রাসে মেতে ওঠে। তারা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, এমনকি বাসাবাড়িতে পরিকল্পিত আক্রমণ করছে। এসবকে উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কিছু মূল ধারার গণমাধ্যম সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করছে। এসব গণমাধ্যম মব সন্ত্রাস এবং উচ্ছৃঙ্খলতার সত্যতা যাচাই না করেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। যাকে খুশি তাকে ফ্যাসিস্টের দোসর, ফ্যাসিস্টের দালাল বলছে। এতে মব সন্ত্রাসীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে।

মিডিয়া ট্রায়ালের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেসরকারি খাতের ওপর দাঁড়িয়ে। গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন কিছু শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী। যাঁরা নিজেদের জীবনের আনন্দ, সুখ, শান্তি বিসর্জন দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত করেছেন। শিল্প-কারখানা গড়েছেন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের এই উৎপাদনমুখী তৎপরতায় বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে মধ্য আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এই বেসরকারি উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের টার্গেট করা হয়েছে মিডিয়া ট্রায়ালে। হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যম বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকারকে প্ররোচিত করছে—যেন এসব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের এ ধরনের প্রতিটি প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক।

দেশের স্বনামখ্যাত কয়েকটি শিল্পগ্রুপকে টার্গেট করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে, যেসব প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা নেই। আবার এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই দুর্নীতি দমন কমিশন বা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তদন্ত করছে। তদন্তের নামে শিল্পগ্রুপকে হয়রানি করছে। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করেই তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির ওপর চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ভয়ে-আতঙ্কে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলছেন। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ফলে অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। গত ৯ মাসে এক লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন। অনেক শিল্প-কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ। বেশ কিছু ব্যবসায়ী বিনা বিচারে তথাকথিত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার। এতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা।

এক-এগারোর সময় একবার ব্যবসায়ীদের টার্গেট করা হয়েছিল বাংলাদেশ যেন অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর হয়ে যায়। পরনির্ভর হলে বিদেশি ঋণের ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন বিদেশিরা বাংলাদেশে ঋণ দিতে নানা ধরনের শর্ত আরোপ করবে। এই শর্তের বেড়াজালে বিদেশিদের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ব আমরা। এখন আবার ঠিক সেই এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের কথা ধরা যাক। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেই শর্তগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের পরিপন্থী। ডলারের মূল্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে সরাসরি বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যেই ১২২ টাকা থেকে প্রতি ডলারের মূল্য ১২৯ টাকায় উপনীত হয়েছে। সামনের দিনগুলোয় ডলারের মূল্য আরো বাড়তে পারে। কেউ কেউ ধারণা করছেন ডলারের দাম বেড়ে ২০০ টাকা হতে পারে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জুলাই বিপ্লবের পর যদি ব্যবসায়ীদের পাশে ডেকে নেওয়া হতো, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে বৈঠক করেছে, একইভাবে যদি ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হতো, তাহলে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারতেন। সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু সেই পথে যাওয়া হয়নি। বরং ব্লেইম-গেমের মাধ্যমে অর্থনীতিবিনাশী তৎপরতা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো হচ্ছে। অবিলম্বে এই মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করা উচিত।

মূল ধারার কিছু গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা ধরনের গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে গুজব এবং বিভ্রান্তিকর খবরের বিরুদ্ধে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুজব-বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। জনগণের আস্থার শেষ ভরসাস্থল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করা কারো উচিত নয়।

আরেকটি এক-এগারো রুখে দিতে এখনই মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ যদি গড়তে হয়, বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে অপতথ্য ঠেকাতে হবে। বাংলাদেশে যাঁরা বিরাজনৈতিকীকরণের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কিছু গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন তাঁদের লাগাম টেনে ধরতে হবে।সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গণমাধ্যম কমিশন গঠন করেছে। ওই গণমাধ্যম কমিশন নতুন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের পাঁয়তারা করছে। এমন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে ওই কমিশন রিপোর্ট তৈরি করেছে, যেটি শুধু মুক্ত গণমাধ্যম পরিপন্থী নয়, বরং দেশে বিরাজনৈতিকীকরণ এবং অর্থনীতি ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

দেশটা আমাদের সবার। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের যেসব দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে, তার প্রতিটি দেশই বেসরকারি খাতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বেসরকারি খাতকে পাশে নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। বেসরকারি খাতকে শত্রু বানিয়ে, বেসরকারি খাতকে হয়রানি করে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে, তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া হত্যা মামলা দায়ের করে কখনো দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *