ক্লাস-পরীক্ষা হয় না ৩ মাস, বিপাকে সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থী

সংঘর্ষের জেরে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ৩ মাস ধরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় বেড়ে গেছে সেশনজট। নতুন ব্যাচের ক্লাসও শুরু হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছেন ৭ হাজার ৫৬৫ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকায় সহসা কাটছে না সংকট। একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ। সংকট নিরসনে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। কুয়েটে এমন অচলাবস্থা আগে কখনও কেউ দেখেনি।
কুয়েটের শিক্ষার্থী মো. মহিউজ্জামান মোল্লা উপল, মো. মোহন আলী, শেখ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ৩ মাসের অচলাবস্থার কারণে কুয়েটের সব শিক্ষার্থীই সেশনজটে পড়েছে। আমরা বুয়েট ও রুয়েট থেকে এগিয়ে ছিলাম, এখন আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে গিয়েছি। একাডেমিক কার্যক্রম চালু হওয়ার পরও এই গ্যাপ সহজে পূরণ হবে না। ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় নিজেরাও ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছি না। শিক্ষার্থীরা পাশ করে বেরিয়ে পরিবারের হাল ধরতে পারছে না।
এদিকে নতুন ব্যাচের ১ হাজার ৬৫ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে তা এখনও অনিশ্চিত। গত ২৪ এপ্রিল থেকে তাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল।গত ৪ মে থেকে একাডেমিক কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত হলেও ওই দিন থেকে ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের লাঞ্চিতকারী শিক্ষার্থীদের শাস্তি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ক্লাসে না ফেরার সিদ্ধান্ত রয়েছে শিক্ষক সমিতির। এছাড়া ১৮ মে থেকে একাডেমিক কাজ থেকেও বিরত রয়েছেন তারা।
শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নের উদ্যোগ হিসেবে গত ১২ মে কুয়েট কর্তৃপক্ষ ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে শোকজ করে। এর প্রতিবাদে ১৩ মে থেকে আবারও আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ১৫ মে’র মধ্যে তাদের শোকজ নোটিশের জবাব দেওয়ার কথা থাকলেও তারা কেউই দেয়নি।আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রাহাতুল ইসলাম বলেন, অপসারিত উপাচার্যের সময়ে গঠন করা তদন্ত কমিটির পক্ষপাতিত্বমূলক প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদেরকে শোকজ করা হয়। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্যের কাছে নতুন করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য দাবি জানিয়েছি।
কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বাইরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দোষীদের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছে। যার কারণে কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম সংকটের মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা ৪ মে থেকে ক্লাস বর্জন করছি। তার আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও কুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে ক্লাস হয়নি।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুল ইসলাম জানান, সোমবার তারা এক ঘণ্টা প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। মঙ্গলবারও তাদের একই কর্মসূচি রয়েছে।এদিকে কুয়েটের শিক্ষার্থীরা এখন দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক গ্রুপ শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে। গত ৩ মাস ধরে আন্দোলন করা অন্য গ্রুপ আপাতত চুপচাপ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একাংশ শিক্ষকদের পক্ষে অবস্থায় নেওয়ায় অন্য গ্রুপ কিছুটা চাপে পড়েছে। এখন তারা কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুয়েটের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ দাবিতে অনড় থাকায় মূলত সংকট নিরসন হচ্ছে না। উভয় পক্ষই একে অপরকে ছাড় দিতে নারাজ।
এ ব্যাপারে কুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হযরত আলী বলেন, যোগদানের পর ভেবেছিলাম ২/৪ দিনের মধ্যে ক্লাস শুরু করে দিতে পারবো, কিন্তু তা হয়নি। এখানে যে এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়ে আছে তা আমার আগে জানা ছিল না। আমি আসার পর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সংকট সমাধানের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।আলতাফ হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, এই সংকট না হলে আমার ছেলে এতোদিনে কুয়েট থেকে পাশ করে বেরিয়ে চাকরি পেয়ে যেতো। কিন্তু যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমরা অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন।
সংকট নিরসনে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।আরেক অভিভাবক মোহাম্মদ আলী বলেন, এর আগে কখনও এতো দীর্ঘ সময় ধরে কুয়েটে অচলাবস্থা হয়নি। সংকট নিরসনে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।প্রসঙ্গত, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও বহিরাগতদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়। ওই দিন কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী তৎকালীন উপাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্চিত করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি কুয়েট কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক কার্যক্রম ও হল বন্ধ ঘোষণা করেছিল। ৪ মে থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।