
সুইফট কিংবা ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম এর উপর স্যাংশন আরোপ করে পশ্চিমা দুনিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে একঘরে করে সরকার পরিবর্তন করে। অতি সম্প্রতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমরা এর ব্যবহার দেখেছি। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারে উৎখাতে কৃত্তিম ডলার সংকট তৈরির কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু সেটা সুইফ্ট ব্যবহার করে করা হয়নি। করা হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কে প্ররোচিত করার মাধ্যমে।শেখ হাসিনা সরকারকে ডলার সংকটে ফেলে বিপদে ফেলার মূল অস্ত্র ছিলো রেমিটেন্স। কিছু দেশ থেকে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ আটকে দিয়ে ডলারের কৃত্তিম সংকট তৈরি করে পাবলিক পার্সেপশন খারাপ করা হয়েছিল।

চলেন ডাটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি।চিত্র ১ এ বাংলাদেশের মোট মাসিক রেমিট্যান্স ইনফ্লো দেখতে পাবেন (১০ মিলিয়ন টাকায়)। সময় জুলাই ২০১৮ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত। চিত্র ২ এবং ৩ এ বাংলাদেশের মাসিক রেমিট্যান্স ইনফ্লো (১০ মিলিয়ন টাকায়) মাসের এবং দেশের হিসেবে দেয়া হয়েছে। এই তথ্যগুলোর সূত্র ব্লুমবার্গ।


চিত্র ২ এবং ৩ এ প্রধান দশটা রেমিট্যান্স পাঠানো সূত্র/দেশ আলোচনায় নেয়া হয়েছে।তিনটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবো।১) আসলেই কি ইউনুস রেমিট্যান্স বাড়াতে পেরেছে?২) রেমিটেন্স কে ব্যবহার করে কোনো ষড়যন্ত্র হয়েছে কি?৩) কোন দেশ থেকে এবং কখন রেমিটেন্স নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়ে থাকতে পারে?চিত্র ১ থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রেমিটেন্স ২০০০ সাল থেকেই কোভিড এবং ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেন কনফ্লিক্ট এর কারণে মারাত্মকভাবে কম ছিলো।
জুলাই ২০২০ পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ইঙ্গিত দিলেও, আগস্ট ২০২০ থেকে কোভিডের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাংলাদেশিদের চাকরি চলে যাওয়া এবং ঐসব দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাবের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ যেমন ভাবে বাড়ার কথা ছিলো তা হয়নি। যদিও রেমিট্যান্স এন্টি সাইক্লিক্যাল, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সংঘাত চলমান থাকলে রেমিটেন্স সহ সকল অর্থনৈতিক সূচক নিম্নগামী হতে বাধ্য।ফেব্রুয়ারি ২০২২ এ রাশিয়া-ইউক্রেন কনফ্লিক্ট শুরু হলে ইতিমধ্যে কোভিডের কারণে নিম্নগামী রেমিট্যান্স আরও খারাপ রূপ ধারণ করে। ডিসেম্বর ২০২২ এর দিকে কোভিড কে অফিসিয়ালি শেষ ঘোষণা করা হলেও থেকে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন কনফ্লিক্ট। আশ্চর্যনক হলেও সত্য, শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে রেমিটেন্স বাড়াতে সক্ষম হন। জুলাই ২০২৪ নাগাদ বাংলাদেশের রেমিটেন্সের উর্ধ্বগতি ছিলো যা ২৯৯.৪০ (প্রায় ৩০০) বিলিয়ন “টাকা” পর্যন্ত উঠে।এরপরই বিদেশে অবস্থানরত কিছু সন্ত্রাসী জুলাই আগস্টের মিথ্যা প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যাঙ্কিং চ্যানেলে রেমিটেন্স না পাঠিয়ে হুন্ডি করে পাঠাতে কিংবা একদম রেমিটেন্স বন্ধ করে দিতে প্রচারণা চালায়। এতে জুলাই ২০২৪ এ রেমিট্যান্স কমে গিয়ে ২২৫.৭ বিলিয়ন টাকায় ঠেকে।
আগস্ট মাসে ইউনুস অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা নেয়ার পরেও রেমিট্যান্স আগের অবস্থায় পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে।মনে রাখা ভালো বছরের মাঝামাঝি এবং শেষে/পরের বছরের শুরুতে দেশে রেমিটেন্স বেশি আসে।এর থেকে দুইটা জিনিস পরিষ্কার।১) মিথ্যা প্রচারণা না চালালে বাংলাদেশের রেমিটেন্স যা আসছিলো শেখ হাসিনার সময়ে, তা এখনকার ইউনুসের সময়ের রেমিট্যান্স প্রবাহের চাইতে বেশি হতো। বরং এখন রেমিটেন্স প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম আসছে।২) এতগুলো মেজর ক্রাইসিস ম্যানেজ করেও শেখ হাসিনা সরকার খুব ভালোভাবে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ঠিক রাখতে পেরেছিলেন। অথচ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে নতুন বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার হার কমে গেছে প্রায় ৩৩% এর মতো। এর প্রভাব পড়বে সামনে।তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, রেমিট্যান্স বাড়লেও হঠাৎ করে এই পরিমাণ বাড়ার কোনো কারণ নেই। আমরা যেমন জুন-জুলাই ২০২৪ এ বিপদে ছিলাম, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখান থেকে রেমিট্যান্স আসছিলো
সে সব দেশেও সমস্যা চলছিলো। এই জন্য আমি একটু ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করতে চাচ্ছি।আমার হাইপোথিসিস হচ্ছে,১) শেখ হাসিনা সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য যে কৃত্তিম ডলার সংকট তৈরি করা হয়েছে, এবং২) শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার জন্য যে টাকা এসেছে তার একটা অংশ রেমিট্যান্স এর সাথে জড়িত এবং তা কিছু নির্দিষ্ট দেশের সাথে জড়িত।চিত্র ২ এ দেখুন বাংলাদেশের রেমিটেন্স ইনফ্লো প্রধান দশটা সোর্স থেকে (১০ মিলিয়ন টাকায়) মাসের হিসেবে। ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ডাটা আছে। ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। তার পরেই ছিলো আমেরিকা। সেপ্টেম্বর ২০২৪ এর পর থেকে আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি এসেছে যেটা জানুয়ারি ২০২৫ এর এসে অনেকখানি কমে গেছে। আগস্টের একই সময় থেকে মালয়েশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্স ও অনেক বেড়ে যায় যেটা জানুয়ারিতে এসে কমে যায়। জুনের আগে সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স কমতে থাকে। জুন-জুলাই থেকে আবার বাড়তে থাকে।জুলাই এ আমেরিকা থেকে আসা রেমিট্যান্স ছিলো ২৮.২ বিলিয়ন টাকা, যেটা ডিসেম্বর ২০২৪ এ দাঁড়ায় ৬৭.৮০৪ বিলিয়ন টাকায়। মালয়েশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্স যেখানে এপ্রিল ২০২৪ এ ছিলো মাত্র ১৪.৬২ বিলিয়ন টাকা, তা আগস্ট ২০২৪ এর দাঁড়ায় ২৯.৯১ বিলিয়ন টাকায়। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে এত বড় পরিবর্তন অকল্পনীয়। এই পরিবর্তন সরাসরি শেখ হাসিনার সরকার পরিবর্তনের সময়ের সাথে জড়িত।রেমিট্যান্স প্রবাহ কমিয়ে দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলা ছিলো এই প্রক্রিয়ার অংশ। তাহলে গত কয়েক মাসে কেন রেমিট্যান্স প্রবাস বেড়ে যাওয়ার পরেও বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বাড়ছেনা? আশাকরি বুঝতে পারছেন কোন দেশ থেকে কারা কেনো ডলার পাঠিয়েছে। জুলাই-আগস্টের রেমিটেন্সের এই ঊর্ধ্বগতিতে শুধু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই ছিলনা, তার সাথে প্রতারণা করে সরকার ফেলে দেয়া ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার স্বরূপ ডলারও এসেছে রেমিটেন্স হিসেবে।আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে চিত্র ৩ খেয়াল করুন। ইতালি, ওমান, কাতার, কুয়েত, এবং অন্য সব দেশ মিলিয়ে রেমিটেন্স প্রবাহ অন্যান্য মাসের মতো একই রকম ছিলো অথবা কমে যাচ্ছিলো। কিন্তু মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স জুন-জুলাইয়ের পর বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। ডিসেম্বর ২০২৪ এর পর সেই সব দেশে আবার রেমিট্যান্স আগের অবস্থায় ফেরত যাচ্ছে। এতে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে বাংলদেশের রেমিট্যান্স কে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতে জনগণের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরিতে এবং দেশে কৃত্তিম ডলার সংকট তৈরিতে ব্যবহার করেছে। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এটাও পরিষ্কার যে রেমিট্যান্স সবসময় এন্টি সাইক্লিক্যাল না। দেশের মানুষ বিপদে পড়লেও একটা গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে রেমিট্যান্সকে অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে।জেনোসাইড বিভিন্ন রকমের হয়। রেমিটেন্স নিয়ে এই মরণ খেলা অর্থনৈতিক জেনোসাইডের অংশ, যার ফল অনেকগুলো মানুষকে হত্যা করে দেশ বিক্রির পথ খুলে দেয়া। লেখক পরিচিতঃ ড মামুনুর রশীদ অর্থনীতিবিদ, যুক্তরাজ্য