
মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক হারে অস্ত্রের চালান ঢুকছে দেশে। এসব চালানের মধ্যে ভারী অস্ত্র ও রকেট লঞ্চারও রয়েছে। অস্ত্র পাচারকারীরা এসব অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেডসহ বিস্ফোরক মজুদ করেছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরে গহিন পাহাড়ে। পাহাড়ে অস্ত্রের মজুদ থেকে এসব অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে।কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, জেলায় সম্প্রতি অস্ত্র পাচার, কেনাবেচা এবং অস্ত্র নিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। গত ১৭ মাসে জেলায় ৩২১টি অস্ত্র আইনের মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত মে মাস পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে ৭০টি মামলা করা হয়েছে।
গত বছরের একই সময়ে মামলা করা হয়েছিল ২৫১টি। জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, একমাত্র রোহিঙ্গাদের কারণেই অস্ত্রসংক্রান্ত অপরাধ বেড়েছে। অস্ত্র পাচার, বেচাকেনা এবং সশস্ত্র অপরাধের বেশির ভাগের সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত।কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত র্যাব সদস্যরা কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এক হাজার ২৭৯টি অস্ত্র উদ্ধার করেছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে অস্ত্র বেচাকেনার তথ্যও তাদের কাছে রয়েছে। ক্যাম্পে সংগৃহীত অস্ত্র বেচাকেনার পর দেশের অন্যত্র পাচারের সময় হাতেনাতে ধরাও পড়েছে পাচারকারীরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্ত এলাকায় কর্মরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, দেশি-বিদেশি অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং ক্যাম্পসংলগ্ন টেকনাফ ও উখিয়ার গহিন পাহাড়ে। বিদেশি অস্ত্রের বেশির ভাগ আসছে মায়ানমার থেকে এবং দেশীয় অস্ত্র আনা হয় মহেশখালী দ্বীপ থেকে। পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের ভ্রাম্যমাণ আস্তানা থাকে।
অভিযান চালানোর পর আস্তানা এক স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয় অপরাধীরা। গত শনিবার রাতে টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুরা থেকে তিন হাজার ১১৪ রাউন্ড রাইফেলের গুলিসহ বিদেশি অস্ত্রের চালান উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড ও পুলিশ। কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ এ তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, পাচারকারীরা অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। আত্মরক্ষায় যৌথ বাহিনী ফাঁকা গুলি বর্ষণ করলে পাচারকারীরা পাহাড়ে গাঢাকা দেয়। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা গহিন পাহাড়ের আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে একটি বিদেশি রাইফেল, দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি একনলা আগ্নেয়াস্ত্র, রাইফেল ও পিস্তলের তিন হাজার ১১৪ রাউন্ড তাজা গুলি এবং পাঁচ কোটি তিন হাজার ৬০০ টাকা মূল্যের এক কেজি আইস ও চার লিটার দেশীয় মদ জব্দ এবং অপহৃত এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন।
গত ৩১ মে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড স্টেশন টেকনাফ ও টেকনাফ থানার পুলিশ টেকনাফ সীমান্তের দমদমিয়ার নেচার পার্ক এলাকায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছিল ১০টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১০টি হ্যান্ড গ্রেনেডের ডেটোনেটর, ২৯ রাউন্ড রাইফেলের গুলি। অভিযানে পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কাউছার সিকদার জানিয়েছেন, অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত রয়েছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা ডাকাতি ও অপহরণ কাজে ব্যবহারের জন্যও অস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে।
গত বছরের ৯ জুন উখিয়া থানায় বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের দায়ের করা একটি মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, বিজিবি সদস্যরা গত বছরের ৬ জুন সকালে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিলে অভিযান চালিয়ে বিপুল বিদেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। বিজিবি সদস্যরা ২৩ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন পাঁচটি এসএমজি, একটি রাইফেল, দুটি পিস্তল, চারটি রিভলভার এবং এসব অস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য ৮৯৩ রাউন্ড গুলি। অস্ত্র আইনে মামলাটি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ২ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক মো. রবিউল আলমের আদালতে বিচারাধীন। ২৩ রোহিঙ্গা আসামির মধ্যে ১৮ জন জামিনে রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি ও উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অস্ত্রপাচারের ঘটনায় মহাচিন্তায় রয়েছি। সীমান্তের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এতকাল ইয়াবার ডিপো ছিল। কিন্তু এখন অস্ত্রেরও ডিপো হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমান্তের এসব অস্ত্র নিয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।