
পুলিশের মাঠপর্যায়ে ভারি মারণাস্ত্র না রাখার ঘোষণায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত অপরাধীদের জন্য বড় ধরনের সুসংবাদের শামিল। এতে দেশে বিদ্যমান অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।১৪ই জুন, শনিবার সকালে রাজধানীতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদর দপ্তর পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “মাঠপর্যায়ের পুলিশের কাছে রাইফেলের মতো অস্ত্র থাকলেও ভারি মারণাস্ত্র থাকবে না। শুধুমাত্র এপিবিএনের মতো বিশেষায়িত ইউনিটের কাছেই ভারি অস্ত্র থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “এপিবিএন ও থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।”তার দাবি, “দু-একটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া দেশবাসী এবারের ঈদ শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করেছে।”তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যকে ঘিরে আশঙ্কার সুর শোনা যাচ্ছে অপরাধ বিশ্লেষক ও মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিজ্ঞদের কণ্ঠে।তাদের মতে, এপিবিএন সবসময় ও সর্বত্র মোতায়েন থাকে না। বাস্তবিক অর্থে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও থানার দায়ভার বহন করে সাধারণ পুলিশ সদস্যরাই।
একজন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “মাঠপর্যায়ের পুলিশের হাতে ভারি অস্ত্র না থাকলে সেটা একপ্রকার অপরাধীদের জন্য সুসংবাদ। অস্ত্রধারী অপরাধী, সন্ত্রাসী কিংবা চরমপন্থিদের মোকাবেলায় তখন পুলিশ দুর্বল অবস্থানে পড়বে। এতে শুধু অপরাধ প্রবণতা বাড়বে না, বরং পুরো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাই ঝুঁকিতে পড়বে।”তিনি আরও বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনাটি এখানে প্রনিধানযোগ্য। সেদিন জঙ্গিদের ভয়ানক অস্ত্রের মুখোমুখি হয়ে তাদের তৎপরতা ঠেকাতে গিয়ে প্রাথমিক অবস্থাতেই শহিদ হন দুই পুলিশ সদস্য। বিশেষায়িত ইউনিট আসার আগে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর দায়িত্ব বর্তায় পুলিশের ওপর। কিন্তু পুলিশের যদি সেই সক্ষমতা না থাকে, তবে লড়বে কীভাবে?
অপরাধ বিশ্লেষক ড. আহসান হাবিব মনে করেন, “যখন দেশজুড়ে মাদক, ছিনতাই, গ্যাং কালচার, রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে, তখন পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করার মতো বার্তা দেওয়া দায়িত্বশীল পদে থাকা কারো উচিত নয়। অপরাধীরা এমন ঘোষণাকে উৎসাহ হিসেবে নিতে পারে।”তিনি আরও বলেন, “যদি পুলিশের হাতে যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়েই ব্যস্ত থাকবে, জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। গত বছরের ৪ ও ৫ই আগস্ট সারাদেশে ৪৬০টি থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পূলিশকে যেভাবে কচুকাটা করা হয়েছে, তারপর থেকে এমনিতেই পুলিশের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এরমধ্যে তাদের নিরস্ত্রীকরণ করা হলে, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাবে।”
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বাংলাদেশে অনেক অপরাধ সংগঠিত হয় পূর্বপরিকল্পিতভাবে এবং অনেক সময় এতে ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে মোতায়েনকৃত পুলিশ যদি সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করতে না পারে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার।গত বছর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা সারাদেশের ৪৬০টির বেশি থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। বেসরকারি তথ্যমতে, এ ঘটনায় অন্তত কয়েক হাজার পুলিশ নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনা মনে করিয়ে দেয় যে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র কতটা জরুরি।এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, অস্ত্রের প্রশ্নে এই ধরনের অতি-সতর্কতা একপাক্ষিক চিন্তা হতে পারে, যার প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে।সামগ্রিকভাবে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্য মাঠপর্যায়ে নতুন করে দুশ্চিন্তা ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষিত, আধুনিক এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামে সুসজ্জিত রাখাই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল শর্ত—তাতে কোনো ছাড় দেয়া উচিত নয়।